জন্মঃ ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) মক্কার বনু তাইম গত্রে ৫৭৩ সালের ২৭ অক্টোবর জন্ম গ্রহন করেন। মক্কায় আব্রাহার বাহিনীর আক্রমনের তিন বছর পর জন্ম গ্রহন করেন অর্থাৎ তিনি রাসুল (সাঃ) এর থেকে বয়সে ছোট।
পারিবারিক পরিচয়ঃ আবু বকর (রাঃ) মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যাবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর গোত্রের নাম আবদুল্লাহ ইবনু আবি কুহাফা আত-তাইমি আল-কুরাইশি। তাঁর পিতা উসমান ইবনু আমির যিনি আবু কুহফা নামে পরিচিত এবং তাঁর মাতা সালমা বিনতে শাখার তিনি উম্মুল খাইর নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি মক্কার কুরাইশ বংশের অন্তর্গত। বংশগতভাবে তিনি রাসুল (সাঃ) এর সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। শৈশবকালে অন্যান্য শিশুদের মত তিনিও আরব বেদুঈনদের মধ্যে কাটিয়েছেন। তখন তার মধ্যে উটের জন্য বিশেষ অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। তখন থেকে তার ডাকনাম আবু বকর রাখা হয়। আবু বকর অর্থ “উটের বাছুরের পিতা।” তাঁর পুত্র সন্তান আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ ও মুহাম্মদ এবং কন্যা সন্তান আসমা, আয়েশা (রাঃ) ও উম্মে কুলসুম। তাঁর কন্যা হযরত আয়েশা (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর স্ত্রী এবং তিনি উম্মুল মুমিনিন অর্থাৎ মুমিনদের মা।
আস-সিদ্দিক উপাধি প্রাপ্ত- রাসুল (সাঃ) যখন মিরাজের ঘটনা বর্ণনা শুরু করলেন তখন উপস্থিত কুরাইশারা তাঁর কথা বিশ্বাস করল না। পরবর্তীতে তারা এই কথা হযরত আবু বকর (রাঃ) কে জানায়। তিনি জিজ্ঞেস করেন যে, “রাসুল (সাঃ) কি এই কথা বলেছেন?” তখন তারা বলল, “ হ্যাঁ, তিনি এই কথা বলেছেন।” তখন আবু বকর (রাঃ) বললেন, “যদি রাসুল সাঃ এই কথা বলে থাকেন তিনি সত্য বলেছেন।” সত্যকে বিশ্বাস করার কারণে রাসুল (সাঃ) তাঁকে “আস-সিদ্দিক” উপাধি দেন। আস-সিদ্দিক শব্দের অর্থ সত্যাবাদী, যে সত্যকে বিশ্বাস করে।
যুদ্ধ ও অভিযানঃ আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই রাসূল (সাঃ) এর পাশে ছিলেন। তিনি:
• বদর, উহুদ, খন্দক সহ সব বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
• হিজরত–এর সময় গুহায় থকাকালীন রাসূল (সাঃ) এর সঙ্গী ছিলেন।
• ইসলাম প্রচারে নিজের সম্পদ ব্যয় করেন এবং বহু দাস-মুক্ত করেন (যেমন: বিলাল রাঃ)
প্রিয় রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের দিন- বিশ্ব মানবতার দূত প্রিয় রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাত মুসলিম উম্মাহের জন্য গভীর শকের মুহূর্ত। সেদিন সাহাবিদের অনেকেই এই সত্য মেনে নিতে পারছিলেন না। এমনকি হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেছিলেন,
“যে বলবে মুহাম্মদ (সাঃ) মারা গেছেন, আমি তার মাথা কেটে ফেলব! বরং তিনি তাঁর প্রভুর সাথে সাক্ষাতের জন্য গেছেন, মূসা (আঃ) যেমন গিয়েছিলেন, তিনি আবার ফিরে আসবেন!”
তখন আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এসে নবিজি (সাঃ)-এর মাথায় চুম্বন করে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনি জীবিত থাকা অবস্থায় যেমন মহিমান্বিত ছিলেন, মৃত্যুর পরও তেমনি আপনি মহিমান্বিত।” পরবর্তীতে তিনি শোকার্ত সাহাবিদের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলেন। তিনি কুরআন থেকে উল্লেখ করেন,
"মুহাম্মদ তো একজন রাসূল মাত্র; তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল অতিক্রান্ত হয়েছেন। তবে কি তিনি মারা গেলে বা নিহত হলে তোমরা নিজেদের আগের অবস্থায় ফিরে যাবে?"
— (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৪৪)
এই আয়াত শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। অনেকেই বলেন:“আমরা যেন এই আয়াত প্রথমবার শুনছি!”
উমর (রাঃ)–ও স্বীকার করেন, তার পা কাঁপতে থাকে এবং তিনি মাটিতে বসে পড়েন। তখনই সাহাবীরা ধীরে ধীরে ধৈর্য ফিরে পান এবং বাস্তবতা মেনে নিতে সক্ষম হন।
খলিফার দায়িত্ব গ্রহন- রাসুল (সাঃ)–এর ইন্তেকালের পর সাহাবীগণ একমত হয়ে আবু বকর সিদ্দিক রাঃ–কে ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন।
তাঁর খিলাফতের প্রধান কাজগুলো:
• বিদ্রোহী গোত্র দমন (রিদ্দা যুদ্ধ)
• মিথ্যা নবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (যেমন: মুসাইলিমা ও তলাইহা)
• কুরআন সংকলনের উদ্যোগ (ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফেয সাহাবী শহিদ হন। তখন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) উপলব্ধি করেন, এভাবে হাফেয সাহাবী শাহদাত বরন করলে কুরআন এর বহু অংশ হারিয়ে যাবে। এবং এই কথা খলিফার নিকট বলেন। প্রথমে আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি বলেন:“আমি এমন একটি কাজ কীভাবে করব যা রাসূল (সাঃ) করেননি?”কিন্তু পরে তিনি বুঝলেন, এটি একটি জরুরি ও কল্যাণকর কাজ। তিনি সাহাবী যায়েদ ইবন সাবিত (রাঃ)–কে দায়িত্ব দেন কুরআন সংকলনের:"তুমি একজন যুবক, বুদ্ধিমান, এবং রাসুল (সাঃ)-এর জন্য ওহি লিখতে। এখন তুমি কুরআনের আয়াতসমূহ একত্র করো।")
• পারস্য ও রোমানদের বিরদ্ধেও যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং খিলাফত আরবের বাইরেও প্রতিষ্ঠা করেন।
মৃত্যুঃ প্রিয় রাসুল (সাঃ)-এর অন্যতম সাহাবী আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) দুই বছর তিন মাস খিলাফত পরিচালনা করেন। একদা তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল। এমন অবস্থায় তিনি বিছানায় শায়িত থাকেতেন। তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর ইহকালের যাত্রা শেষ হয়ে আসছে। তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে ডেকে পাঠেলেন এবং অনুরোধ করলেন তাঁকে মৃত্যুর পর যেন তিনি গোসল করান। কেননা হযরত আলি-ই (রাঃ) নবীজিকে গোসল করিয়েছিলেন। কিছুকাল পর, ৬৩৪ সালের (হিজরী ১৩ সন) ২৩ আগস্ট ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রজিউন)।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছিলেন একজন উদার মানুষ। তিনি দাসদের মুক্ত করে দিতেন। দাসদের মধ্যে যারা নিপীড়িত, দুর্বল ও ইসলাম গ্রহনের কারনে নির্যাতিত ছিলেন, তিনি তাদেরকে ক্রয় করে মুক্ত করে দিতেন। একদা তাঁর পিতা তাঁকে বলেছিলেন যে, “তুমি দুর্বল দাসের পরিবর্তে সবলদের ক্রয় কর এবং মুক্ত কর যেন তারা পরবর্তীতে তোমার কাজে আসে।” তখন তিনি বললেন, আমি দাস আমার জন্য মুক্ত করি না, আমি তা আল্লাহর জন্য করি।” তাঁর এই কথাটি পরিপূর্ণ ইমান ও দৃঢ় নিয়তের প্রতিফলন। আমলের দিক দিয়েও তিনি ছিলেন সেরা। তাঁর সাথে অন্য সাহাবীগণ আমলের প্রতিযোগিতা করতেন। একদা উমর (রাঃ) বলেন: একদিন আমি মনে মনে ভাবলেন:“আজ আমি আবু বকর (রাঃ)–কে ছাড়িয়ে যাব। আজ এমন কিছু দেব আল্লাহর রাস্তায়, যা তিনি কখনো দেননি।” তিনি নিজের সম্পদের অর্ধেক অংশ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে নিয়ে এলেন এবং বললেন:“হে আল্লাহর রাসূল, আমি আমার সম্পদের অর্ধেকটা আল্লাহর রাস্তায় দান করলাম।” এরপর এলেন আবু বকর (রাঃ): তিনি রাসুল (সাঃ)-এর নিকট এসে তাঁর সম্পদের পুরোটা নিয়ে এলেন। রাসুল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন: “হে আবু বকর! তুমি নিজের জন্য কী রেখে এলে?” তিনি বললেন: “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে।” উমর (রাঃ) তখন বলেন: "আবু বকরকে আমি কখনোই ছাড়িয়ে যেতে পারব না!" (উৎস: তিরমিজি শরিফ, হাদীস: ৩৬৭৫)
Comments
Post a Comment